
এম আব্দুল মান্নান
বাংলাদেশের উপকূল মানেই জীবন ও সংগ্রামের গল্প। এখানে সাগর শুধু ভৌগোলিক পরিচয় নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকা, আশা আর বেঁচে থাকার লড়াই। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায় শত শত বছর ধরে সাগরকে আঁকড়ে ধরে টিকে আছে। তারা দেশের মাছের যোগানদাতা, খাদ্য নিরাপত্তার মূলভিত্তি। অথচ এই জনগোষ্ঠী আজও অবহেলিত, অধিকারবঞ্চিত এবং নিরাপত্তাহীন।
আমার নিজের জীবনও এই বাস্তবতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমার বাবা লবণচাষী ও ব্যবসায়ী হলেও আমার চারপাশের বেশিরভাগ মানুষ জেলে শ্রমিক। শৈশবে বহুবার ঘুম ভেঙেছে কান্নার শব্দে। কখনো জলদস্যুর আক্রমণে, কখনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে, আবার কখনো অসুখ-বিসুখে তাদের মৃত্যু হয়েছে। আমার চোখের সামনে বড় হয়েছে একটি প্রজন্ম, যাদের জীবন মানেই ঝুঁকি, যন্ত্রণায় ভরা সংগ্রাম।
মহেশখালীতে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ সাগরে মাছ ধরার শ্রমিক। তারা সোনাদিয়ার মগচর, ঘড়িভাঙার শুঁটকি চর, মুদিরছড়া, ধলঘাটা, মাতারবাড়ির মতো স্থানে জীবন ও জীবিকা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু আজ সেই সব জায়গা হারিয়ে গেছে। চর বিলীন হয়েছে, জমি গিয়েছে, অথচ ক্ষতিপূরণ বা বিকল্প জীবিকা মেলেনি। ফলে এই জনগোষ্ঠী আরও অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে।
জেলে সম্প্রদায়ের জীবন শুধু কঠিন পরিশ্রম নয়, তাতে জড়িয়ে আছে এক অদৃশ্য ভয়। প্রতিদিন সাগরে যাত্রা করা মানে অনিশ্চিত যুদ্ধে নামা। কে ফিরবে, কে ফিরবে না—সে উত্তর সাগরের ঢেউয়ের হাতে। রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা অপ্রতুল হওয়ায় জলদস্যু ও দস্যুচক্রের কাছে তারা আজও অসহায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি, সঠিক স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার অভাব। ফলে একদিকে তারা দেশের আমিষের যোগান দেয়, অন্যদিকে নিজেরা বঞ্চিত হয় ন্যূনতম নিরাপত্তা থেকেও।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্যখাতের অবদান অপরিসীম। বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আসে মাছ রপ্তানি থেকে। দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানও এই খাতের সঙ্গে জড়িত। অথচ যারা প্রতিদিন জীবন বাজি রেখে মাছ ধরে আনে, তারা জাতীয় নীতিতে সবচেয়ে কম গুরুত্ব পায়। সরকার মাঝে মাঝে প্রণোদনা বা সহায়তা দিলেও তা সাময়িক। কোনো স্থায়ী নিরাপত্তা বা সামাজিক সুরক্ষা গড়ে ওঠেনি।
আমার বিশ্বাস, উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত। তাদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে, স্বাস্থ্যসেবায় সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সাগরে দুর্ঘটনায় নিহত বা নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারকে দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা দিতে হবে। একইসঙ্গে ডাকাতি ও জলদস্যু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
আজ প্রশ্ন একটাই—আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যারা জীবন বাজি রাখে, সেই জেলে শ্রমিকরা কি কখনো নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাবে না? রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব কি শুধুই তাদের ঘাম আর রক্ত নেওয়া, নাকি তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা?
উপকূলের মানুষ এখনও অপেক্ষা করছে সেই দিনের জন্য, যখন তাদের জীবন সংগ্রাম আর্তনাদ নয়, বরং সম্মান ও নিরাপত্তার আলোয় আলোকিত হবে।
লেখক – একজন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কথা বলি।


