
খন্দকার মো. জসীম উদ্দিন
সাংবাদিক, কলাম লেখক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও রাষ্ট্রচিন্তক
বিশ্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে নিজ নিজ ধর্মমত ও আদর্শের প্রতি যেভাবে আমরা সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করি, ঠিক সেভাবেই অন্য ধর্মমত ও আদর্শের প্রতিও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিকল্প নেই। নিজের ধর্ম ও আদর্শকে সম্মান করার অর্থ কখনোই অন্যের ধর্ম ও আদর্শকে অবজ্ঞা করা নয়। বরং বিশ্বের ঐক্য, সংহতি ও মানবিক সহাবস্থানের জন্য সব ধর্ম ও আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অনিবার্য।
একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্নে সে দেশের জনগণের ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্র নামক বিশাল ভূখণ্ডে বিভিন্ন মত, পথ ও আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের অবস্থান থাকাই স্বাভাবিক। এই ভিন্নতার মধ্যেই রাষ্ট্রের সৌন্দর্য, শক্তি ও স্থায়িত্ব নিহিত। বিভিন্ন মতপথের মানুষের চিন্তা-চেতনার পার্থক্যের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি হয় এবং একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।
প্রতিটি আদর্শের দুটি রূপ থাকে,একটি উদার, অপরটি কট্টর। আদর্শ যখন মানবকল্যাণ, সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে চর্চিত হয়, তখন তা সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু যখন সেই আদর্শ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে, উন্নয়ন ও উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সমাজে বিভাজন ও সংঘাত ডেকে আনে,তখন তা রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যা ভাবি বা বিশ্বাস করি, তা আমাদের দৃষ্টিতে সঠিক মনে হলেও সেটি রাষ্ট্র ও সামগ্রিক জনগণের কল্যাণে কতটা সহায়ক,সে প্রশ্ন নিজেকেই করতে হবে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আদর্শ বাস্তবায়নের নামে যদি অন্য মানুষের অধিকার, বিশ্বাস ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, তবে সেই আদর্শ আর মানবিক থাকে না।
বিশ্বের নানা দেশে নানা জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ বসবাস করছে। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আত্মিক পথচলার বিষয়। আমি যে ধর্মে বিশ্বাস করি, আমার প্রতিবেশী বা সহনাগরিক হয়তো সে ধর্মে বিশ্বাস করেন না,এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার বিশ্বাসে আঘাত করার অধিকার আমার নেই। প্রত্যেকেই তার ধর্ম ও আদর্শকে সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত হিসেবে বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসকে সম্মান করাই মানবিকতার মূল শিক্ষা।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশ্ব আজ একটি বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। একটি দেশের কোনো ঘটনা মুহূর্তেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রযুক্তি যেমন মানুষে-মানুষে দূরত্ব কমিয়েছে, তেমনি ধর্মীয় বিদ্বেষ, শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার ও আদর্শিক কট্টরতা বিশ্ব মানবতাকে গভীরভাবে আহত করছে।
বিশ্বের কোনো প্রান্তে ধর্ম বা আদর্শের নামে সহিংসতা ঘটলে তা শুধু একটি ভূখণ্ডের সমস্যা থাকে না,তা পুরো মানবজাতির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো, শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভ দেখানো,এসবই মানবতাকে কলঙ্কিত করে।
আমাদের দেশেও রাজনীতিতে বহু মত ও পথের অনুসারী মানুষের অবস্থান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আদর্শিক পার্থক্য এখন নৈতিক শত্রুতায় রূপ নিচ্ছে। জাতি ক্রমশ বিভক্ত হয়ে পড়ছে, যেখানে কেউ কাউকে সামান্য ছাড় দিতেও রাজি নয়। এই বিভাজন কতটা আদর্শিক আর কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ—তা গভীরভাবে ভাবার সময় এখনই।
রাষ্ট্র নিয়ে ভাবনা অত্যন্ত দায়িত্বশীল কাজ। শুধু নিজের রাষ্ট্র নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হয়। এই ভাবনা যদি সহনশীলতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে না হয়, তবে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘাত, অস্থিরতা ও বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়।
আজ বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি যে মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তা হলো,আমি যে ধর্মে বা আদর্শে বিশ্বাস করি, সেটিই একমাত্র শ্রেষ্ঠ।”
এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জন্ম নেয় বিদ্বেষ, সহিংসতা ও মানবিক বিপর্যয়।
আমি যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে যদি অন্য ধর্ম বা মতের মানুষের ওপর আঘাত করি—তবে অন্য কোনো দেশে আমারই ধর্ম বা আদর্শের অনুসারীরা সংখ্যালঘু হয়ে একই আচরণের শিকার হতে পারে। মানবতা এখানে দ্বিমুখী নয়; এটি সর্বজনীন।
ধর্ম ও আদর্শ মানুষের জন্য,মানুষকে ধ্বংস করার জন্য নয়। ধর্ম ও আদর্শের চূড়ান্ত লক্ষ্য যদি মানবকল্যাণ, শান্তি ও সহাবস্থান না হয়, তবে সেই চর্চা আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। তাই বিভাজনের রাজনীতি নয়, অনৈক্যের সৌন্দর্যকে ঐক্যে রূপান্তর করাই হোক আমাদের পথচলার দিশা।
কারণ, মানবতার ঐক্য ছাড়া কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, কোনো বিশ্বও নয়।


