সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৫১ পূর্বাহ্ন [gtranslate]
Headline
টার্গেট কিলিং, পত্রিকা অফিসে অগ্নিসংযোগ ও নির্বাচন প্রশ্নে অশনি সংকেত
/ ৫৮ Time View
Update : বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

খন্দকার মো. জসীম উদ্দিন
সাংবাদিক, কলাম লেখক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও রাষ্ট্রচিন্তক

দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ও প্রত্যাশার কোনো ঘাটতি ছিল না। প্রায় দেড় দশক ধরে দেশবাসী নানাভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত ছিল। বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ভোটাধিকারের প্রশ্নে মানুষ মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে বহু তাজা প্রাণ ঝরেছে, অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে বিগত সরকারের পতনের পর মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। মানুষ বিশ্বাস করেছিল—অতীতের অপকর্ম, নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি আর হবে না। নাগরিকরা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করবে, স্বস্তিতে জীবন যাপন করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্রে সংঘটিত সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সেই আশার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।

বর্তমানে দেশে এমন কিছু ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনা ঘটছে, যা অতীতের অনেক রেকর্ডকেও হার মানিয়েছে। কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলা, কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে যুবককে গাছে ঝুলিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা, পত্রিকা অফিসে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া—এসব ঘটনা কোনোভাবেই সভ্য রাষ্ট্রের চিত্র হতে পারে না। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। মানুষের মাঝে বাড়ছে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা। সচেতন নাগরিকরা ক্রমেই নিজেকে অসহায় মনে করছেন।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কাউকে নির্মমভাবে হত্যা করার কোনো নৈতিক, ধর্মীয় বা মানবিক বৈধতা নেই। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ—এই শ্রেষ্ঠত্বের মূল প্রমাণ হলো মানবিকতা, সহমর্মিতা ও ন্যায়বোধ। স্রষ্টা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন—পাপ-পুণ্যের চূড়ান্ত বিচার তাঁরই হাতে। পৃথিবীতে কাউকে স্বর্গ-নরকের ফয়সালা দেওয়ার অধিকার কোনো মানুষের নেই।

কেউ যদি ধর্ম অবমাননা করে থাকে, তবে তাকে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করে প্রচলিত আইনে বিচারের ব্যবস্থা করাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ। কিন্তু ময়মনসিংহে যুবককে গাছে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে যা জানা যাচ্ছে, তা আদৌ ধর্ম অবমাননার ঘটনা নয়। এটি একটি চাকরি-সংক্রান্ত বিরোধকে ধর্মীয় ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করে সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ড। এই অপরাধীরা শুধু পার্থিব আইনেই নয়, পরকালের বিচারের মুখোমুখিও হবে—এ বিশ্বাসই মানবতার শেষ আশ্রয়।

আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো টার্গেট কিলিং। শরিফ ওসমান হাদিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে—এ কথা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। খুলনাতেও অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। একটি রাষ্ট্রে যখন সামাজিক ঐক্য ভেঙে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে, তখনই এ ধরনের টার্গেট কিলিং মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছিল। সেই শূন্যতা পূরণে দেশের সশস্ত্র বাহিনী অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। তারা কতটা সফল বা ব্যর্থ—তার মূল্যায়ন করবে জাতি। তবে বাস্তবতা হলো, নিরাপত্তাহীনতা এখনো কাটেনি।

এরই মধ্যে দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সৌভাগ্যক্রমে কোনো সাংবাদিক বা কর্মচারীর প্রাণহানি হয়নি—এটাই একমাত্র স্বস্তির বিষয়। কিন্তু মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে সংবাদমাধ্যমে হামলা, প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষের জীবনের ঝুঁকি তৈরি করা—এগুলো গণতন্ত্র ও সভ্যতার পরিপন্থী।

অল্প কয়েক মাস পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই পারে দেশকে স্থিতিশীলতার পথে ফেরাতে। কিন্তু এই মুহূর্তে যদি রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়ে, তবে নির্বাচনের পরিবেশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন দেশ ধীরে ধীরে একটি অকার্যকর ও অকল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।


এর ফল ভোগ করবে সাধারণ মানুষ—ইজ্জত, জান ও মালের নিরাপত্তা চরমভাবে হুমকির মুখে পড়বে। এই বাস্তবতা যত দ্রুত দেশবাসী অনুধাবন করবে, তত দ্রুতই রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
দেশের স্বার্থে আমাদের একটি সত্য গভীরভাবে লালন করতে হবে—
ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Our Like Page