
কক্সবাজার জেলার উপকূল এলাকা বাকখালী নদীর তীরেজুড়ে মহেশখালীতে নেমে এসেছে শীতের হিমেল ছোঁয়া। পাহাড়ি ও উপকূলীয় জনপদে এখন রাতের বেলাতেই টের পাওয়া যাচ্ছে শীতের আমেজ। কোথাও কোথাও কম্বল জড়িয়ে কাটাতে হচ্ছে রাত। এমন আবহেই সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন, নেপালসহ বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ পেরিয়ে দলে দলে বাংলার পথে ছুটে আসছে অতিথি পাখির দল।
প্রতিবছরের মতো এবারও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ ও বাঁকখালী নদীর দুই পারে সৃষ্টি হয়েছে পাখির অনাবিল অভয়ারণ্য। প্রাকৃতিক নীরবতা ভেঙে নানা প্রজাতির অতিথি পাখির কিচিরমিচির, কাকলি আর ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্য মন ভরিয়ে দিচ্ছে পর্যটকদের। শীতের শুরুতেই পাখির ঝাঁক দেখতে ভ্রমণপিপাসু মানুষের ভিড় বাড়ছে এসব এলাকায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ১০–১১ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত ফিরিঙ্গাবন ও লেগুনার জলভূমি এখন পরিযায়ী পাখির আধিপত্যে। ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য পাখি দলবেঁধে আকাশে ওড়ে। কখনো পানিতে ভাসে, আবার কখনো খাবারের সন্ধানে ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায়।
কক্সবাজার থেকে মহেশখালীতে ঘুরতে আসা পর্যটকরাও থমকে দাঁড়ান এই অপার সৌন্দর্যের কাছে। অনেকে ক্যামেরায় বন্দি করছেন স্বপ্নিল মুহূর্তগুলো।
ভ্রমণে আসা পাখিপ্রেমী আমজাদ হোসেন বলেন,
“আমি বরাবরই পাখিপ্রিয়। আগে ঘরে পাখি পুষতাম, পরে সেগুলো মুক্ত করে দিয়েছি। এবার সোনাদিয়ায় এসে এত ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির দেখা মিলবে ভাবিনি। সত্যিই মন ভরে গেল।”
সোনাদিয়া এলাকার ডিঙি নৌকার মাঝি গিয়াস উদ্দিন বলেন,”মাঝে মাঝে বন্দুক নিয়ে শিকারিরা আসত। এখন আর খুব জোরে আসে না। তবু পুরোপুরি থামেনি।”
মহেশখালী উপজেলা ছাত্রদল নেতা মিজানুর রহমান বলেন,”সোনাদিয়া ও বাঁকখালী এলাকায় প্রতিবছরই অতিথি পাখির আনাগোনা বাড়ে। চাইলে এখানেই গড়ে উঠতে পারে বৃহৎ পক্ষীকুল অভয়াশ্রম। এজন্য পাখি গবেষকদের পরামর্শ নিয়ে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।”
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক পরিবেশগত ভারসাম্য, জলাশয়ের সুরক্ষা এবং শিকার প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা গেলে সোনাদিয়া হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম পরিযায়ী পাখির স্বর্গরাজ্য।
যদিও অতিথি পাখির আগমন হৃদয় ভরায়, কিন্তু বছর বছর তাদের সংখ্যা কমছে,এমন মত স্থানীয়দের।
একসময় মহেশখালীর খাল-বিল, ধানক্ষেত ও নদীপথজুড়ে দেখা যেত বালিহাঁস, পানকৌড়ি, ডাহুক, কানা বক, মাছরাঙা, সরালি, লেন্জা, গাঙচিলসহ নানা প্রজাতির পাখির মেলা। অথচ এখন বেশিরভাগ জায়গায় এরা আর দেখা যায় না।
গোরকঘাটা চরপাড়ার বৃদ্ধ আব্দুল মালেক জানালেন,
“আগে শীত এলেই চরজুড়ে বিকেলের দিকে পাখির কিচিরমিচিরে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। এখন কয়েকটা গাঙচিল আর লেন্জা ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়ে না।”
স্থানীয়দের দাবি,শিকারিদের ফাঁদ ও গুলিই পাখিদের সবচেয়ে বড় হুমকি,অনেক মাছের প্রজেক্টে ব্যবহৃত কীটনাশক পাখির জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে,জলাশয় দখল ও দূষণও কমাচ্ছে পাখির খাদ্য ও আবাসস্থল
প্রায় প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এপারে আসে এসব শীতপ্রধান দেশের পাখি।
বাংলাদেশের,নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া,খাদ্যের প্রাচুর্য
নিরাপদ জলাভূমি,সমুদ্র উপকূলের উষ্ণতা
এসবই তাদের কাছে হয়ে ওঠে পরিবারের মতো,নিরাপদ আশ্রয়।
অতিথি পাখির আগমন শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অংশই নয়,এটি একটি সুস্থ পরিবেশের বার্তাও বহন করে।সঠিক উদ্যোগ নিলে সোনাদিয়া–বাঁকখালী এলাকা হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ পক্ষী অভয়াশ্রম। আর একটু সচেতনতা—শিকার বন্ধ ও জলাশয় দূষণ কমালেই আবারও ফিরতে পারে পাখির সেই হারানো দিন।


